দীপাবলী কি? এর উৎপত্তি এবং তাৎপর্য

দীপাবলী -: দীপাবলী হলো আলোর উৎসব, প্রদীপ জ্বালিয়ে অশুভ শক্তিকে দূর করা অর্থাৎ অন্ধকারকে দূর করে আলোকে স্বাগতম জানানো। এই উৎসব হিন্দু ধর্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ খুব জনপ্রিয় বড়ো উৎসব। এই উৎসব ৫ দিন ধরে পালিত হয়,ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদযাপিত হয়। এই আলোর উৎসব সকল ধর্মের – বর্ণের মানুষকে একত্রিত করে সম্প্রীতির বার্তা দেয়। দীপাবলীর মূল উদ্দেশ্য হলো – জীবনের অন্ধকারকে দূর করে আলোতে আসা। অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে শান্তি ও শুভ শক্তির প্রতীক করে তোলা।

ছোট দীপাবলী কি -: দীপাবলীর ঠিক আগের দিন ছোট দীপাবলী পালিত হয়।এই দিনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুর নামে এক ভয়ঙ্কর রাক্ষসকে বধ করে মানবজাতির মুক্তি দিয়েছিলেন। এই ঘটনাকে স্মরণ করে নরক চতুর্দশী বা ছোট দীপাবলী পালিত হয়। এই দিন বাড়ী- ঘর পরিষ্কার করে চারিদিকে প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোয় ভরিয়ে দেওয়া হয় এবং বিভিন্ন মিষ্টি খাওয়া দাওয়া হয়।

দীপাবলী উৎপত্তি ও ইতিহাস -: দীপাবলীর উৎপত্তির ইতিহাস নানা ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কাহিনী ও রিতি প্রচলিত আছে। দীপাবলীর উৎসব শুরু হয় কোজাগরী পূর্ণিমার লক্ষ্মী পূজোর পর ত্রয়োদশী দিন থেকে।

(১) প্রথম দিন ধনতেরাস -: ধনতেরাস দিনে সোনা,রূপোর লক্ষ্মী গণেশ ঠাকুর বা বাসনপত্র কিনে ধন- সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর পূজা করার প্রচলন রয়েছে যা ধন- সম্পদ বৃদ্ধির প্রতীক বলে মনে করা হয়।

(২) দ্বিতীয় দিন -: নরক চতুর্দশী এই দিনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করার ঘটনা স্মরণে উদযাপিত হয়। আবার কোথাও ভূত চতুর্দশী পালন করা হয়। দুটি একই প্রথা অশুভ শক্তি দূর করার জন্য প্রদীপ জ্বালানো বিভিন্ন খাবার তৈরি ও ঘর বাড়ি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা।

(৩) তৃতীয় দিন – অমাবস্যার রাত্রে দীপাবলী উদযাপন যে যে ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে -:

(ক)-: রামায়ণের সঙ্গে সম্পর্কিত -: হিন্দু মহাকাব্যে রামায়ণ এর সাথে সংযুক্ত দীপাবলীর কাহিনী। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র ১৪ বছর বনবাস পালন শেষ করে সীতা এবং তাহার সঙ্গীদের নিয়ে অযোধ্যায় ফেরেন। শ্রী রামচন্দ্রের এই প্রত্যাবর্তনের আনন্দে অযোধ্যাবাসী রাস্তা,ঘাট,ঘর বাড়ি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে প্রদীপ জ্বালিয়ে অযোধ্যা নগর আলোকিত করেন। এই দিনটির স্থরনে দীপাবলী উদযাপিত হয়ে আসছে।
(খ) মহাভারতের সঙ্গে সংযোগ -: মহাভারতে ও দীপাবলীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ আছে। পাণ্ডবরা বনবাস পালন থেকে ফিরে আসার দিন প্রদীপ জ্বালিয়ে তাদের স্বাগত জানিয়ে জনসাধারণ ব্যাপক আনন্দ উল্লাস করেছিলেন।এই দিনকে দীপাবলীর উৎসবের অংশ বলে মনে করা হয়।
(গ) লক্ষ্মী পূজো ও কৃষ্ণের সঙ্গে সংযোগ -: হিন্দু ধর্মে ধন- সম্পদের ও সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মীর পূজার সাথে দীপাবলীর সম্পর্কিত। বিশ্বাস আছে যে দীপাবলীর রাত্রে লক্ষ্মী দেবী মর্তে নেমে আসেন।যার বাড়ি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন প্রদীপের আলোতে আলোকিত করে দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয় সেই বাড়িতে লক্ষ্মী দেবী আসেন এবং সেই ভক্তকে আশির্বাদ প্রদান করেন।
(ঘ) জৈন ও শিখ ঐতিহ্য -: জৈন ধর্মের মহাবীর স্বামী মোক্ষ লাভ করেন দীপাবলীর দিন। তাই জৈন ধর্মের মানুষের কাছে এই দিনটি শুভ এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ।
শিখ ধর্মের গুরু হরগোবিন্দজী জাহাঙ্গীর কারাগার থেকে মুক্তি পান দীপাবলীর দিন।তাই শিখ ধর্মের মানুষের কাছে এই দীপাবলী ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ দিন। তাই এই দুই ধর্মের মানুষ বিশেষ ভাবে দীপাবলী উদযাপন করেন।

(৪) চতুর্থ দিন গোবর্ধন পূজা বা অন্নকূট -: দীপাবলীর পরের দিন প্রথমা এই দিনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের স্মরণে গোবর্ধন পূজা করা হয়। গোবর্ধন পূজা হলো ভগবত পুরান মতে বৃন্দাবনে ব্রজবাসীদের মুষলধারে বৃষ্টি থেকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গোবর্ধন পর্বতকে তার কনিষ্ঠ আঙ্গুলে একটি বড়ো ছাতার মতো তুলেছিলেন যাতে সমস্ত মানুষ এবং প্রাণীরা আশ্রয় নিতে পারে ।সাত দিন মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছিল। বৃষ্টি থেমে গেলে নন্দ মহারাজ সমস্ত প্রজাদের জন্য বিশাল খাবারের আয়োজন করেন এটাই অন্নকূট। শ্রী কৃষ্ণের এই অবদানের স্বরণে গোবর্ধন পূজা বা অন্নকূট উৎযাপন করা হয়।

(৫) পঞ্চম দিন ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটা -: দীপাবলীর শেষ দিন ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটা এটা হিন্দুদের একটি পালিত উৎসব। এই উৎসব কার্তিক মাসে শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে উদযাপিত হয়।এর পৌরাণিক কাহিনী হলো সূর্য পুত্র যমরাজকে তার বোন যমুনা এই দিনে তাকে ফোঁটা দিয়েছিলেন।যমরাজ খুব খুশি হয়ে বোনকে বর চাইতে বললেন যমুনা বলে তুমি প্রতি বছর এই দিনে আমার বাড়ীতে এসো আর যে বোন এই দিনে ভাইকে ফোঁটা লাগাবে তার অকাল মৃত্যুর ভয় থাকবে না। যমরাজ খুব খুশি হয়ে আশীর্বাদ করেন এইভাবে ভাইফোঁটা শুরু হয়।এই দিনে বোনেরা ভাইয়ের মঙ্গল ও দীর্ঘায়ু কামনা করে ফোঁটা দেয় মিষ্টি খাওয়ায় আর ভাইরা বোনের উপহার দেয়। ইহা যমদ্বিতীয়া ,ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, ভাইফোঁটা,ভাই টিকা,ভাই দুজ নামে পরিচিত।

দীপাবলীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব -: বর্তমানে দীপাবলী কেবলমাত্র একটা ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রধান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব। দীপাবলীর উপলক্ষে বন্ধু – বান্ধব, আত্মীয় স্বজন একত্রিত হওয়া এবং উপহার বিনিময় চলে যা পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও অনেক মজবুত করে তোলে। বিভিন্ন স্থানে দীপাবলী বিভিন্ন রূপে পালিত হয়। পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কালি ও লক্ষ্মী পূজো আয়োজন করা হয়। অশুভ শক্তি দূর করতে কালি পূজা, আর ধন- সম্পদ সমৃদ্ধির জন্য লক্ষ্মী পূজো করা হয়। দক্ষিণ ভারতে তামিলনাড়ু এবং অন্ধ্রপ্রদেশে নরক চতুর্দশী উদযাপন করা হয়। ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে ধনতেরাস পালন করা হয়। উত্তর ভারতের বেশী দীপাবলী পালিত হয়।

দীপাবলীর আধুনিক রূপ -: দীপাবলীর আলোর উৎসব বর্তমান সমাজে অনেক উন্নত হয়েছে। প্রদীপের আলোয় সাথে সাথে বৈদ্যুতিক আলো ও সোলার প্যানেলের আলোতে বেশী আলোকিত ও সুসজ্জিত করা হয়। মানুষের স্বাস্থ্যের দিকে লক্ষ্য রেখে পরিবেশের বায়ু দূষণ যাতে না হয় তার জন্য পটকা ফোটানো বন্ধো করা হয়েছে।

উপসংহার -: দীপাবলী কেবলমাত্র একটা ধর্মীয় উৎসব নয়। নতুন করে জীবন শুরু করার বার্তা দেয়। এটা সুখ সৌভাগ্যের প্রতীক। আমাদের বোঝায় এই যে অন্ধকার থেকে আলোতে আসতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top