ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের রূপ গুলো। -: (১) মৎস্যাবতার (২) কূর্মাবতর (৩) বরাহ অবতার (৪) নৃসিংহ অবতার (৫) বামন অবতার (৬) পরশুরাম অবতার (৭) রাম অবতার (৮) কৃষ্ণ অবতার (৯) বুদ্ধ অবতার (১০) কল্কি অবতার।
মৎস্যাবতার -: যখন পৃথিবীতে পাপে পরিপূর্ণ হয়। মানুষের অন্যার কামনা বাসনার দ্বারা বিশৃঙ্খল হয়ে ওঠে তখন প্রকৃতি অভিশাপ দেয়। এর ফলে প্রাকৃতিক বিপযয় ঘটে। এর সঙ্গে দানবরা মুনি ঋষিদের উপর অত্যাচার শুরু করে। দানবরা মুনি ঋষিদের বেদগ্ৰন্থকে চুরি করে সমুদ্রের নিচে লুকিয়ে রাখে। এই সব দেখে মহাত্মা মনু বুঝতে পারে এবার পর্তন হবে অনিবার্য। কারন এটাই তো স্বাভাবিক প্রকৃতির নিয়ম। মহাত্মা মনু চিন্তা করে কি ভাবে এই সৃষ্টিকে রক্ষা করা যায়। একদিন তিনি কৃতমালা নদীতে স্মান করে হাতে আঁজলায় জল তুলে তপন করতে যাচ্ছেন হঠাৎ দেখতে পেলেন তার হাতে জলের মধ্যে একটি ছোট মাছ। মনু মহারাজ জল সমেত মাছটিকে ফেলে দেবে এমন সময় মাছটি মানুষের গলায় মতো করে বলে আপনি অনুগ্ৰহ করে আমাকে রক্ষা করুন। এই নদীতে আবার আমাকে ফেলে দিলে বড়ো মাছরা আমাকে খেয়ে নেবে। বাঁচার জন্যে আমাকে এখানে সেখানে এলোমেলোভাবে ছুটোছুটি করতে হচ্ছে। এভাবে আমার জীবন বাঁচানো বড় কষ্টকর। ছোট মাছের মুখে মানুষের মতো এমন কথা শুনে মনু মহারাজ অবাক হয়ে গেল মনে মনে মায়া জাগলো। তাই তিনি মাছটি জলে না ফেলে, মাছটি নিয়ে প্রাসাদে এসে একটা নিরালায় জায়গায় একটা কমণ্ডলুর জলের মধ্যে মাছটিকে রেখে দিলেন। পরেরদিন সকালে মাছটিকে দেখে মনু মহারাজ অবাক হয়ে গেল। মাছটি কমণ্ডলুর মধ্যে আর ধরছে না। একদিনে এত বড়ো হয়ে গেছে। মাছটি বলে প্রভু আমাকে একটা বড় জায়গা দেন আমার অসুবিধা হচ্ছে। এরপর মনু মহারাজ মাছটিকে নিয়ে তাঁর বাগানে একটি সরোবরের জলে ছেড়ে দিলেন। মাছটি মনের আনন্দে সেই জলে খেলতে লাগল। পরদিন সকালে মনু মহারাজ দেখল মাছটি এত বড় হয়ে গেছে সে আর সরোবরে নড়াচড়া করতে পারছে না। মনু মহারাজ বুঝতে পারলেন, এই পৃথিবীতে ভগবানের অনুগ্ৰহ ছাড়া কোনো কিছু লাভ করা সম্ভব নয়। ভগবান ইচ্ছা করলে এমন অসাধ্য সাধন করতে পারেন যা আমাদের কল্পনার অতীত। এটা ও হয়তো ভগবানের লীলা।রাজাকে দেখে মাছটি আবার কাতর কন্ঠে বলে প্রভু আমার আরো বড় জলাশয় দরকার হচ্ছে।তখন মনু মহারাজ অনেক লোক জন ডেকে মাছটি নিয়ে নদীর জলে ছেড়ে দিলেন। মাছটি মনের আনন্দে সাঁতার কাটতে লাগল। পরদিন সকালে মনু মহারাজ দেখলো দেশ জুড়ে বর্না, দারুন বিপর্যয় মানুষের প্রান বুঝি আর না বাঁচে। মনু মহারাজ এই বন্যার কারণ জানতে নদীর কাছে আসেন দেখলেন মাছটি নদীর ওপর আড়াআড়ি ভাবে শুয়ে আছে।আর নদীর জলরাশি এই মাছের শরীরে বাঁধা পেয়ে জনপদ ভাসিয়ে দিয়েছে তাই বন্যা। রাজাকে দেখে মাছটি আবার কাতর কন্ঠে বলে আমার কোনো দোষ নেই। অনুগ্ৰহ করে আমাকে আপনি আরো বড়ো জলাশয়ে রাখুন। মাছের কাতর আর্তনাদ শুনে মনু মহারাজ অনেক লোক জনকে ডেকে অতি কন্ঠে মাছটিকে নদী থেকে তুলে সাগরের জলে নিয়ে এলেন। মাছটিকে সাগরের জলে রাখা মাত্র মাছটি চোখের পলকে এত বড় হয়ে গেছে সাগরের জল বুঝি তাকে আর আশ্রয় দিতে পারছে না। গোটা সাগরকে সে যেন গ্ৰাস করে ফেলবে। এই দৃশ্য দেখে মনু মহারাজ বুঝতে পারলেন এই মাছটি নিশ্চয়ই সাধারণ মাছ নয়। মাছের বেশ ধরে স্বয়ং ঈশ্বর তাঁর সঙ্গে ছলনা করতে এসেছে। এরপর মনু মহারাজ হাত জোড় করে প্রার্থনা করে বলেন। অনুগ্ৰহ করে বলুন আপনি আপনার পরিচয় ব্যক্ত করুন। মনু মহারাজ দেখলেন মাছটি স্বয়ং নারায়নের রূপ ধারণ করে বললেন শোনো মনু আজ থেকে সাত দিনের মধ্যে শুরু হবে মহাপ্রলয়। আর সৃষ্টিকে রক্ষা করার দায়িত্ব ও উপায় বলে নারায়ন অন্তর ধ্যান হলেন। ভগবান বিষ্ণু নিজে মৎস্য রূপ ধারণ করে হয়গ্ৰীব নামে এক দানবকে হত্যা প্রভু করেছিলেন। হয়গ্ৰীব দানব বেদগ্ৰন্থকে চুরি করে সমুদ্রের নিচে লুকিয়ে রেখেছিল। তাই ভগবান বিষ্ণুকে এই ভাবে মৎস্য রূপ ধারণ করতে হয়েছিল।
কূর্মাবতর -: সত্যযুগে একসময় দৈত্যরা দিনরাত কঠোর ভাবে শাস্ত্র পাট করে প্রবল শক্তি শালী হয়ে উঠে। এই খবরটা দেবতারা জানতে পারেনি। হটাৎ দৈত্যরা স্বর্গরাজ্য আক্রমণ করে প্রবল যুদ্ধ করে দেবতাদের হারিয়ে স্বর্গরাজ্য দখল করে এবং তারা তাদের নিজস্ব নিয়মনীতি অনুসারে শাসনকার্য চালায়। রাজ্য হারা দেবতারা সবাই মিলে ভগবান বিষ্ণুর কাছে গিয়ে সমস্ত কিছু বলেন। আরো বলেন আমরা স্বর্গরাজ্য হারিয়ে দানবদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অসুরদের কবলে পরে পুরো সৃষ্টি রসাতলে যেতে বসেছে। হে প্রভু আপনি অনুগ্ৰহ করে একটা উপায় বলে দিন। ভগবান বিষ্ণু শান্ত স্বরে বললেন তোমাদের এখন বেশী শক্তিশালী হতে হবে কিন্তু তোমাদের শক্তি কম তাই দানবদের সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ না করে তাদের সঙ্গে সন্ধি করো। দানবদের নিয়ে ক্ষীরসাগর মন্থর করো। অমৃত উঠবে সেই অমৃত সুধা কেবল মাত্র তোমারা পান করলে তোমারা বেশি শক্তিশালী হয়ে অসুরদের পরাজিত করতে পারবেন। এই কথা শুনে দেবতারা দানবদের সঙ্গে কুটনিতি নিয়ে বন্ধত্ব স্থাপন করলেন। এরপর মন্দার পর্বত হলো দণ্ড আর বাসুকি নাগ হলো দড়ি, মুখের দিকে ধরে অসুরেরা আর লেজের দিকে ধরে দেবতারা টানাটানি করে ক্ষীরসাগর মন্ত্রন চলে। কিছুক্ষণ সময় কেটে গেল হঠাৎ বিপর্যয় দেখা দেয়, জলে এই বিশাল পর্বত বার বার ঘুরতে ঘুরতে কাঁদায় ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। তখনই দেবতারা আবার ভগবান বিষ্ণুর শরনাপন্ন হন। এই সময়ে ভগবান বিষ্ণু এক বিরাট কচ্ছপ অর্থাৎ কুর্ম রূপ ধারণ করে জলের তলায় গিয়ে মন্দর পর্বতকে নিজের পিঠের ধরে এরপর মন্থন চলে অমৃত উঠে। সেই অমৃত কেবলমাত্র দেবতারা পান করে অসুরদের বধ করেন এবং সৃষ্টিকে রক্ষা করেন।
বরাহ অবতার -: সত্যযুগে আদি দৈত্য দিতির দুই পুত্র হিরন্যাক্ষ আর হিরণ্যকশিপু। হিরন্যাক্ষকে ভগবান ব্রহ্মা বর দেন তার কোন অস্ত্রের আঘাতে তাঁর মৃত্যু হবে না। এর ফলে সে বেপরোয়া হয়ে সমস্ত জীবের এবং দেবতাদের উপর অত্যাচার করে। ঠিক এই সময় দেখা দেয় মহাপ্লাবন পৃথিবী জলের তলায় তলিয়ে যাচ্ছে। এই সময় ভগবান বিষ্ণু বরাহ অর্থাৎ সদা শুকরের রূপ ধারণ করে পৃথিবীকে রক্ষা করেন আর হিরন্যাক্ষকে বধ করেন।
নৃসিংহ অবতার -: সত্য যুগে হিরন্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপু নামে দুই ভাই ছিল। ভগবান বিষ্ণুর কাছে হিরন্যাক্ষ নিহত হন। ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধে নেওয়ার জন্য হিরণ্যকশিপু ভগবান ব্রহ্মার তপস্যা করে। সে বর পায় ব্রহ্মার সৃষ্টি কোন জীবজন্তু, জলে -স্থল – শুন্য বা আগুনে এবং কোন অস্ত্রের আঘাতে তাঁর মৃত্যু হবেনা। এরপর সে ভগবান বিষ্ণুর ভক্তদের উপরে অত্যাচার করে। এই অত্যাচারে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে। ঠিক এই সময় ভগবান বিষ্ণু এক বিরাট প্রানী নৃশংস রূপ ধারণ করে নিজের উরুদ্বয়ের উপর রেখে হিরণ্যকশিপুকে হত্যা করেন। ভগবান বিষ্ণু নৃসিংহ অবতার রূপে হিংসা ও সর্বনাশের হাত থেকে সত্যযুগে পৃথিবীকে রক্ষা করেছিলেন।
বামন অবতার -: সত্যযুগে অসুররাজ বলি বিশ্বজিত নামক যজ্ঞ করেন। এর ফলে বিশাল শক্তি সঞ্চার করে স্বর্গরাজ্য অধিকার করে। দেবতাদের ছোট করার জন্য যাতে সকলের কাছে প্রশংসা পাওয়ার যায় তাই তিনি ঘোষণা করলেন তিনি সবার মনোবাঞ্ছা পূরন করবেন। যে যা দান চাইবে সে পূরন করবেন। এই ভাবে অহংকারী হয়ে উঠৈ। ভগবান কখনো অহংকার মেনে নেয় না তাই ভগবান বিষ্ণু বামন বালকের রূপ ধরে বালির কাছে মাত্র তিন পা পরিমান ভূমি দান চায়।বলিরাজ ও তিন পা ভূমি দান করেন। এখন বামন রূপি ভগবান বিষ্ণু একটি পা স্বর্গলোক আর দ্বিতীয় পা মর্ত্যলোক পর্যন্ত বিস্তৃত করলেন তারপর তৃতীয় পা তুলে বলিকে জিজ্ঞেস করে এই পা কোথায় রাখব এরপর বলিরাজের মাথায় ওপর পা রেখে তাকে পাতালে পাঠিয়ে দেয় তার দম্ভ চূর্ন করে আর পৃথিবী মুক্ত করেন।
পরশুরাম অবতার -: ত্রেতাযুগে পৃথিবীর শাসন ভার ছিল ব্রাহ্মান ক্ষত্রিয়দের উপর। ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এবং ক্ষত্রিয়ের মিলিত হয়ে সুশাসন, শান্তি বজায় থাকবে। মানুষের কোন দুঃখ কষ্ট থাকবে না। বলা ছিল ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়রা নির্লোভ হবে। এক সময় ক্ষত্রিয়া ব্রাহ্মণদের সাথে সহযোগিতা করতে রাজী হলো না। তারা অত্যাচারী হয়ে উঠে। এই সময় ভগবান বিষ্ণু ঋষি জমদগ্নির পুত্র পরশুরাম অবতার রূপে ক্ষত্রিয়দের বধ করে পৃথিবীতে শান্তি ফিরিয়ে আনেন।
রাম অবতার -: ত্রেতাযুগে রাক্ষসরাজ রাবন ভগবান শিবের আশীর্বাদে প্রচণ্ড শক্তিশালী অপরাজেয় হয়ে উঠেছিলেন। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দেবতারা পর্যন্ত তার ভয়ে শান্তিতে দিন কাটাতে পারতেন না।মুনি ঋষিদের উপর অত্যাচার করতো তারা যাগযজ্ঞ সম্পার্ন করতে পারতেন না। সকলেই অসহায় আকুল হয়ে ভগবান বিষ্ণু দেবকে বলেন হে ভগবান আমাদের রক্ষা করো ত্রিভুবনকে বাঁচার। ভক্তদের ডাকে সাড়া দিতে বিখ্যাত ইক্ষাকু রাজবংশে রাজা দশরথের পুত্র রাম অবতার হয়ে রাবনকে বধ করেন ত্রিভুবনে শান্তি স্থাপন করলেন।
কৃষ্ণ অবতার -: দ্বাপর যুগে অসুররাজের অত্যাচার খুবই বৃদ্ধি পেয়েছিল। মানুষ শান্তিতে ধর্মাচরণ করতে পারতেন না। পৃথিবীতে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর মানুষকে উদ্ধার করার জন্য যাদব বংশে দেবকীর গর্ভে বাসুদেবের পুত্র কৃষ্ণ নাম রূপে জন্মগ্ৰহণ করে। কৃষ্ণ অবতারে অত্যাচারী রাজা কংসকে বধ করেন।
বুদ্ধ অবতার -: কলিযুগে এক সময় দানবরা বেদ পাঠ করে প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়ে মানব এবং দেবতাদের উপর অত্যাচার করে। পৃথিবীতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে ভগবান বিষ্ণু বুদ্ধ নামে জন্মগ্রহণ করেন। নতুন ধর্ম প্রচার করেন তার নাম বৌদ্ধ ধর্ম।দানবরা এই ধর্ম না মানার তাদের পরাজয় হয়।
কল্কি অবতার -: কলিকালের শেষের দিকে মানুষের অসহনীয় অবস্থা দূর করার জন্য ভগবান বিষ্ণু শম্ভল নগরে কল্কি অবতার রূপে জন্মগ্ৰহণ করবেন মার নাম সুমতি বাবার নাম বিষ্ণুযশার।তারপর কলিযুগের অবসান ঘটবে আসবে আবার সত্যযুগ।