দেবী সরস্বতীর, হিন্দু ধর্মের জ্ঞান, সঙ্গীত, শিল্প, এবং বিদ্যার দেবী হিসেবে পূজিত হন। দেবী সরস্বতী বিদ্যার আরাধ্য দেবী হিসেবে বিশেষ ভাবে ভারতীয় ঐতিহ্যের গভীর ভাবে জড়িয়ে আছে। তাহার ভক্তরা খুব ভক্তি ভরে তাহাকে পূজা করেন। দেবী সরস্বতীকে সাধারণত শ্বেতবর্না ও শ্বেত বসনে সাজানো হয়। দেবী সরস্বতী শুধুমাত্র ভারতের পূজিত, তা নয় সমস্ত বিশ্বের শিক্ষার ও সাংস্কৃতিকতে তার এক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব আছে।
দেবী সরস্বতীর উৎপত্তি -: দেবী সরস্বতীর কাহিনী সুদূর প্রাচীন বৈদিক যুগে। বৈদিক সাহিত্যে সরস্বতী ছিলো একটি অতি প্রবিত্র গুরুত্বপূর্ণ নদীর নাম।এই সরস্বতী নদী ছিলো মানুষের জীবন ধারণের কেন্দ্র। ঋগ্বেদের শ্লোকে সরস্বতীকে ” শক্তিশালী”,” জ্ঞানদাত্রী”এবং ” অমৃতের উৎস” হিসেবে বর্ননা করা হয়েছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানে এবং পদ্ম পুরানে সরস্বতী হলেন জ্ঞান ও সৃজনশীলতার দেবী।
দেবী সরস্বতীর জন্ম কাহিনী -: দেবী সরস্বতীর জন্ম নিয়ে বহু পৌরাণিক কাহিনি আছে। যেমন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সৃষ্টি কর্মের সময় দেবী সরস্বতীর আবির্ভাব ঘটে। ব্রহ্মা যখন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছিলেন তখন জগতের পূর্ণতা এবং সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষার জন্য দেবী সরস্বতী আবির্ভূত হয়। দেবী সরস্বতী ব্রহ্মাকে সৃজনশীলতা এবং জ্ঞান দিয়ে সহায়তা করেন।
অন্য এক মতে দেবী সরস্বতী হলেন ব্রহ্মার মানসপুত্রী। সৃষ্টি কর্তা ব্রহ্মা অনুভব করেন যে সৃষ্টিকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য জ্ঞান এবং বুদ্ধির প্রয়োজন তাই তিনি এই অভাব পূরণের জন্য একটি শক্তি আহ্বান করেন।এই শক্তি হলো দেবী সরস্বতী আবির্ভূত রূপ। দেবী সরস্বতী নিজের জ্ঞান এবং সঙ্গীতের মাধ্যমে সৃষ্টিকে সুশৃঙ্খল করেন।
দেবী সরস্বতীর স্বামীর নাম -: দেবী সরস্বতী ব্রহ্মার মানসপুত্রী হওয়ার সত্ত্বেও ব্রহ্মা দেবী সরস্বতীর সৌন্দর্যের মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ে করতে চায়, এই সম্পর্কের কথা পুরাণে উল্লেখ আছে। তবে এই সম্পর্ক নিয়ে পৌরাণিক মতানৈক্য আছে।এই কাহিনীর মাধ্যমে প্রাচীন সমাজে সম্পর্কের জটিলতা ও ফুটৈ ওঠে এবং নৈতিকতার প্রশ্ন তোলেন। দেবতারা ব্রহ্মাকে এই সম্পর্ক থাকে বিরত করেন।
দেবী সরস্বতীর রূপ ও প্রতীক -: দেবী সরস্বতীর এক অপূর্ব রূপধারিনী দেবী, সাধারণত শ্বেত বস্ত্র পরিহিতা,হংসবাহনা এবং বীনা ধারিনী। দেবী সরস্বতীর চারটি হাত,এক হাতে বীনা,অন্য হাতে পুস্তক, বাকি দুই হাতে অক্ষমালা এবং কমল ফুল, তাহার বাহন হলো হংস বা ময়ূর, যা বুদ্ধিমাত্তা এবং সৌন্দর্যের প্রতীক।
বীনা -: বীনা হলো সঙ্গীত ও সৃজনশীলতার প্রতীক।
পুস্তক -: পুস্তক হলো জ্ঞান ও শিক্ষার প্রতীক।
অক্ষমালা -: আধ্যাত্মিকতা এবং মনঃসংযোগের প্রতীক।
হংস -: সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতার প্রতীক।
শ্বেত বস্ত্র -: শ্বেত বস্ত্র হলো সরলতা এবং শুদ্ধতার প্রতীক।
কমল ফুল -: কমল ফুল হলো আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ ও সৌন্দর্যের প্রতীক।
দেবী সরস্বতীর বস্ত্র এবং ভিন্ন ভিন্ন আলংকারে বোঝায় তিনি জ্ঞান, সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতার দেবী। দেবী সরস্বতীর পূজায় মানুষের জীবনের জ্ঞান, সৃজনশীলতার ও নৈতিক উৎকর্ষ সাধন করে।
সরস্বতী পূজা কোন তিথিতে হয় -: মাঘ মাসের শুক্ল পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা হয়।( যা বসন্ত পঞ্চমী বা সরস্বতী পূজা নামে পরিচিত।
সরস্বতী পূজার দ্রব্য -: সিন্দুর ,পরোহিতবরণ, তিল, হরিতকী, পঞ্চগুঁড়ি, পঞ্চশস্য,পঞ্চরত্ন,পঞ্চপল্লব, পঞ্চগব্য, ঘাট , কুণ্ড হাঁড়ি, তেকাঠা, দর্পণ,তীরকাঠি,ঘটাচ্ছাদন গামছা, বরণডালা,সশীষ ডাব পঞ্চাতে, এক্সট্রা আতপচাউল, পুষ্পাদি, আসনাঙ্গুরীয়ক, মধুপর্কের বাটী ,নৈবেদ্য, কুচা নৈবেদ্য, সরস্বতীর শাটী, লক্ষ্মীর শাটী, চন্দ্রমালা , বিনাপত্রমালা , থালা , ঘটি , শঙ্খ . লৌহ , নথ , রচনা ,আমের মুকুল, যবের শীষ,কুল, আবির, অভ্র, মস্যাধার (দোয়াত) ও লেখনী, ভোগের দ্রব্যাদি, বালি, কাষ্ঠ, খোড়কে, গব্যঘৃত,পান, পানের মশলা, হোমের বিল্বপত্র, কর্পূর, পূর্ণ পাত্র।
সরস্বতী পূজার মন্ত্র -:
দেবী সরস্বতীর ধ্যান মন্ত্র -: ওঁ তরুণশকলমিন্দো- র্বিভ্রতী শুভ্রকান্তিঃ কুচভরনমিতাঙ্গী সন্নিষন্না সিতাজ্বে নিজকর- কমলোদ্যল্লেখনীপুস্তকশ্রীঃ । সকলবিভবসিধ্যৈ পাতু বাগদেবতা নমঃ॥ যা কুন্দেন্দুতুষারহারধবলা যা শ্বেতপদ্মাসনা যা বীণাবরদন্ড-মন্ডিতভূজা যা শুভ্রবস্ত্রাবৃতা যা ব্রহ্মাচ্যুতশঙ্কর প্রভৃতিভির্দেবৈঃ সদা বন্দিতা সা মাং পাতু সরস্বতী ভগবতী নিঃশেষ জাড্যাপহা ৷
দেবী সরস্বতীর মূল মন্ত্র -: ওঁ ঐং সরস্বত্যৈ নমঃ।
দেবী সরস্বতীর গায়ত্রী মন্ত্র -: বাগদেব্যৈ বিদ্মহে হংসবাহিন্যৈ ধীমহি। তন্নো দেবী প্রচোদয়াৎ।
পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্র -: ওঁ ভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।বেদ- বেদান্ত বেদাঙ্গ- বিদ্যাস্থানেভ্যঃ এব চ।।এষ সচন্দন- বিল্বপত্র- পুষ্পাঞ্জলিঃ ওঁ ঐং শ্রী শ্রী সরস্বত্যৈ নমঃ।( ৩ বার বলতে হবে)
প্রনাম মন্ত্র -: ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে। বীনা রঞ্জিত পুস্তক হস্তে ভগবতী ভারতী দেবী নমোহস্ততে।। ওঁ সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।বিশ্বরূপে বিশালাক্ষি বিদ্যাং দেহি নমোহস্ততে।।
সরস্বতীর স্তব-: শ্বেতপদ্মাসনা দেরী শ্তেতপুষ্পোপশোভিতা। শ্তেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতগন্ধানুলেপনা।।শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচচ্চিতা।শ্বেতবীনাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা বন্দিরা সিদ্ধগদ্ধব্বৈরচ্চিতা দেবাদানবৈঃ। পূজিতা মুনিভিঃ সব্বৈঋষিভিঃ স্তূয়তে সদা।।স্তোত্রেণানেন তাং দেবীং জগদ্ধাত্রী সরস্বতীম্।যে স্মরতি ত্রিসন্ধ্যায়াং সব্বাং বিদ্যাং লভন্তি তে।।
দেবী সরস্বতীর বিশ্বব্যাপী প্রভাব -: শুধু ভারতে নয় , বিশ্বব্যাপী দেবী সরস্বতীর প্রভাব লক্ষ করা যায়। ইন্দোনেশিয়ায়, জাপান, নেপাল, কম্বোডিয়া মতো দেশের ও দেবী সরস্বতীর আরাধনা হয়।
দেবী সরস্বতীর আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা -: বর্তমান সমাজে দেবী সরস্বতীর কেবলমাত্র ধর্মীয় উপাসনার বিষয় নয়, বরং শিক্ষা, সৃজনশীলতা এবং মানসিক উন্নয়নের প্রতীক। শিক্ষার্থীদের একত্রিত হওয়ার এবং তাদের শিক্ষা ও দক্ষতা নিয়ে যাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব।
উপসংহার -: হিন্দু ধর্মে তিন জন শক্তিশালী দেবী হেলেন – সরস্বতী, লক্ষ্মী, দূর্গ ” ত্রিদেবী” , যারা ত্রিদেব অর্থাৎ তিন।প্রধান দেবতা -: ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এই তিন দেবতাদের শক্তির প্রতীক।ত্রিদেবী- সরস্বতী, লক্ষ্মী এবং দূর্গ তিনটি আলাদা আলাদা শক্তির প্রতীক যা এক সঙ্গে বিশ্বজগতের ভারসাম্য রক্ষা করেন।এই তিন দেবী মিলে জীবন ও সমাজের সমস্ত প্রয়োজনীয় দিক পরিচালনা জীবনেরপূর্ণাঙ্গ করেন।ত্রিদেবীর প্রত্যেকে বিশ্বজগতের একটি নির্দিষ্ট দিক পরিচালনা করেন।
দেবী সরস্বতী -: বিশ্বজগতের জ্ঞান এবং সৃজনশীলতার ভারসাম্য রক্ষা করেন।
লক্ষ্মী দেবী -: ঐশ্বর্য এবং সম্পদের প্রতীক। জীবন ও প্রয়োজনীয় সম্পদের ভারসাম্য রক্ষা করেন।
দেবী দুর্গা -: শক্তি এবং সুরক্ষার প্রতীক। শক্তি ও ন্যায় বিচারের ভারসাম্য রক্ষা করেন।
ত্রিদেবীর এই তিন দিক এক সঙ্গে মানুষের পূর্ণতা দেয়।
দেবী সরস্বতী জ্ঞান ও সৃজনশীলতার দেবী,যুগ যুগ ধরে মানুষের অনুপ্রেরণা হিসেবে চলে আসছে। তাহার কাহিনী, পূজা এবং তাহার প্রতীক মানুষের জীবনের নতুন দিশা দেখিয়েছে। দেবী সরস্বতীর কাহিনী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে জ্ঞান এবং সৃজনশীলতা মানব সভ্যতার মেরুদন্ড।