ভূত চতুর্দশী কি ? কবে পালন করা হয়। -: ভূত চতুর্দশী হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠান। কালি পূজার সময় ভূত চতুর্দশী পালিত হয়। ভূত চতুর্দশী পালণ বহুযুগ ধরে চলমান ঐতিহ্যপূর্ণ। ভূত চতুর্দশী পশ্চিমবঙ্গের বেশী পালিত হয়।
ভূত চতুর্দশী কোন দিন পালিত হয় -: হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী অমাবস্যার আগের দিন চতুর্দশী পালণ হয়। দূর্গা পূজার মহালয়া হয় অমাবস্যার তিথিতে, আর ঠিক তার পরের অমাবস্যার রাতে কালি পূজা হয়। কালি পূজার আগের দিন চতুর্দশীতে ভূত চতুর্দশী পালিত হয় সাধারণত কার্তিক মাসে হয়।
ভূত চতুর্দশী কেন পালন করা হয় -: শাস্ত্রে আছে এবং বিশ্বাস হলো যে ভূত চতুর্দশীর দিনে পূর্বপুরুষদের আত্মারা পৃথিবীতে ফিরে আসে। কথিত আছে এই রাতে ১৪ পূর্বপুরুষের আত্মারা তাদের বাড়ির আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। পূর্বপুরুষের আত্মাদের শান্তি কামনা এবং তাদের কাছে আশির্বাদ প্রার্থনা ও ভূত – প্রেত থেকে মুক্তি পেতে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভূত চতুর্দশী পালন করা হয়। ভূত চতুর্দশী দিনটি কালীপুজোর আগের দিন রাতে বলে একে আদ্যাশক্তি কালীর সাথে সম্পর্কিত বলা হয়। এই দিনে কালির ও আরাধনা করা হয়।
ভূত চতুর্দশী পালন -: এই দিনে বাড়ির ভিতরে এবং বাইরে চারিদিকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়।বাড়ির দরজায় সামনে এবং ঠাকুর ঘরে আলপনা দেওয়া হয়।
সন্ধাবেলায় ১৪ প্রদীপ জ্বালানোর প্রথা -: এই দিনে ১৪ টি প্রদীপ বাড়ির বিভিন্ন স্থানে জ্বলিয়ে রাখা হয়। বাড়ির বাইরে চারিদিকে,মূল প্রবেশ দ্বারে এবং সমস্ত দরজার সামনে, জানালার সামনে ঠাকুর ঘরে এই ভাবে ১৪ টি প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা হয়। বিশ্বাস আছে এই প্রদীপের আলোয় ভূত -প্রত চলে যায় অর্থাৎ অশুভ শক্তি চলে গিয়ে শুভ হয়।
খাবার এবং প্রসাদ -: এই দিনে কেবলমাত্র বিভিন্ন ধরনের নিরামিষ খাবার ব্যবহার হয়। বাড়িতে ঠাকুরকে নারিকেল,খই ,চিঁড়ে,মুড়কি, খেঁজুর বিভিন্ন ফল, এবং বিভিন্ন মিষ্টি, নিবেদন করে প্রসাদ বিতরণ ও গ্ৰহণ করা হয়।
১৪ শাক খাবার প্রথা -: ভূত চতুর্দশীর দিনে (১) ওল শাক ,(২) বেতো শাক, (৩) কেঁউ শাক, (৪)কালকাসুন্দে শাক, (৫) সর্ষে শাক, (৬) নিম পাতা, (৭) শালিঞ্চ বা শিঞ্চে শাক, (৮) পটলের পাতা বা পলতা পাতা, (৯) গুড়চী বা গুলঞ্চা শাক, (১০) জয়ন্তী শাক, (১১) হিঞ্চে শাক বা হেলেঞ্চা শাক, (১২) শুষনি শাক, (১৩) ঘন্টাকর্ণ বা ঘেঁটু শাক, (১৪) শুলফা শাক বা শেলুকা শাক, এই ১৪ রকম শাককে যত্ম করে রান্না করে খাওয়া হয়। এই ১৪ শাককে ভূত চতুর্দশীর শাক বলা। বিশ্বাস আছে যে এই ১৪ শাক খেলে অশুভ শক্তির বিনাশ হয় এবং রোগ ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়ার য়ায।
নরক চতুর্দশী কি -: নরক চতুর্দশী হলো এক রকমের ছোট দীপাবলী উৎসব বলে পালিত হয়। দীপাবলীর ঠিক আগের দিন চতুর্দশীতে এই উৎসবটি পালন করা হয়। এটি বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের সাথে সম্পর্কিত। এই দিনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুর নামে এক ভয়ঙ্কর রাক্ষসকে বধ করে মানবজাতির মুক্তি করে পৃথিবীতে শান্তি স্থাপন করেন। এই ঘটনাকে স্মরণ করার জন্য বা আনন্দের দিন হিসেবে নরক চতুর্দশী পালন করা হয়। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক,গুজরাট, এবং দক্ষিণ ভারতে নরক চতুর্দশী বা ছোট দীপাবলী পালিত হয়।
নরকাসুর কে ছিলেন -: নরকাসুর ছিলেন একজন খুব শক্তিশালী ও অত্যাচারী দৈত্য। নরকাসুর ভগবান বিষ্ণুর তপস্যা করে অমরত্ব বর লাভ করেন। অমরত্ব পাওয়ার পর তিনি অহংকারী ও লোভে অত্যাচারী হয়ে ওঠে।লক্ষ লক্ষ মানুষকে তার দাসে পরিণত করে রাখে। এমনকি দেবতাদের উপর ও অত্যাচার শুরু করেন।এর ফলে নরকাসুর একটা বড় অশুভ শক্তির প্রতীক হয়ে ওঠে। দেবতারা নরকাসুরকে বধের জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করেন। তারপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করেন এবং পৃথিবীতে অশুভ শক্তির বিনাশ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
নরক চতুর্দশীর আচার ও রীতি -: নরক চতুর্দশীতেঅভ্যঙ্গ স্থানের গুরুত্বপূর্ণ প্রথা আছে।
ব্রহ্মমুহূর্তে অভ্যঙ্গ স্নান -: ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে নিত্যকর্ম সেরে সূর্যমুখী বা তিল বীজের তেল শরীরে লাগিয়ে ভালো করে ম্যাসেজ করা হয় এবং তার পর স্নান করা হয়। এটা তেল স্নান বলে ও পরিচিত আছে, মনে করা হয় এই স্নান পবিত্র ও শুদ্ধিকরর্ণের প্রতীক। স্নান করে নতুন পোশাক পরিধান করা হয়। মন্দির এবং বাড়ির দরজায় সামনে ” রঙ্গোলি” আঁকা হয়।” রঙ্গোলি” দিয়ে বোঝানো হয় অশুভ শক্তিকে দূর করে শান্তি ও সৌভাগ্যের আমন্ত্রণ জানানো। ঘরে ঘরে বিশেষ খাবার তৈরি করা যেমন পোহা,চাকরি, লাড্ডু এবং বিভিন্ন মিষ্টি। এই দিনে পরিবারের সবাই এক সাথে খেতে বসে খাবার খাওয়া হয়, এটিকে এক ধরনের পরিবারের পুনর্মিলন অনুষ্ঠান হিসেবে মনে করা হয়।
প্রদীপ জ্বালানো -: নরক চতুর্দশীর রাত্রে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিজয়কে স্মরণ করে তাহার উদ্দেশ্যে প্রদীপ জ্বালানো বা প্রজ্বলিত প্রদীপ দান করা হয়। এবং অশুভ শক্তি দূর করার জন্য ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বালানোর গুরুত্বপূর্ণ রীতি আছে।
ভূত চতুর্দশী ও নরক চতুর্দশী মধ্যে সাদৃশ্য -: ভূত চতুর্দশী ও নরক চতুর্দশীর মধ্যে ।
(১) প্রধান সাদৃশ্য হলো দুটি উৎসব অশুভ শক্তির বিনাশ এবং শুভ শক্তির বিজয়কে স্থাপন ও উদযাপন করা।
(২) প্রদীপ জ্বালানো -: দুটি উৎসবের প্রতীক হলো প্রদীপের আলোতে অশুভ শক্তি দূর করা অর্থাৎ অন্ধকারকে দূর করে আলোকে স্বাগতম জানানো।
(৩) বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করার রীতি দুই উৎসবেই আছে।
(৪) ভূত চতুর্দশীতে ১৪ পুরুষের আত্মার শান্তি কামনা ও অশুভ শক্তি ভূত – প্রেত দূরে রাখার জন্য পালন করা হয় এবং নরক চতুর্দশী অশুভ শক্তির বিনাশ উদযাপন করা হয়।
আধুনিক পেক্ষাপটে উদযাপন -: বর্তমান আধুনিক যুগে ভূত চতুর্দশী ও নরক চতুর্দশীর উদযাপন মূল আচার – অনুষ্ঠানকে ঠিক রেখে কিছু নতুন পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগের দিনে কেবলমাত্র প্রদীপ জ্বালানো হতো কিন্তু বর্তমানে প্রদীপ জ্বালানোর পাশাপাশি বিভিন্ন বৈদ্যুতিক আলোকসজ্জায় বাড়ি সাজানো হয়। ভূত চতুর্দশী ও নরক চতুর্দশীর এখন কেবল মাত্র ধর্মীয় উৎসব নয় , বর্তমানে এটি সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে।
উপসংহার -: ভূত চতুর্দশী ও নরক চতুর্দশীর সনাতন ধর্মের সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই অনুষ্ঠান ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক, এবং সামাজিক মূল্যবোধের প্রতীক। প্রদীপের আলোয় মধ্যে দিয়ে অশুভ শক্তির বিনাশ এবং শান্তি ও শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠা এই উৎসব গুলির মূল বার্তা দেয়।