হনুমান একটি গুরুত্বপূর্ণ অমর বীর, তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী, সাহসী এবং বুদ্ধিমান, যিনি “বজরঙ্গবলী ” বা মারুতি নামে ও পরিচিত, হিন্দু ধর্মে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেবতা হিসেবে পূজিত হন। তিনি রামায়ণে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রধান চরিত্র। তিনি ভগবান রামচন্দ্রের একানিষ্ট ভক্ত ও অনুগামী ছিলেন। হনুমানজীর বীরত্ব, অসীম শক্তি, সাহসী, নৈতিকতা ও আনুগত্যের জন্য তিনি সর্বদা অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়, এবং তাহার কাহিনী হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দু পুরাণের ধর্ম ও সংস্কৃতিতে অনুপ্রেরণা হিসেবে স্থান পেয়েছে। জীবন যুদ্ধে সমস্ত বাধা ও সমস্যার সমাধান করতে হনুমানজীকে পূজা করা হয়।
হনুমানজীর জন্ম কাহিনী -: হনুমানজীর বাবার নাম পবনদেব (বায়ুর দেবতা) মায়ের নাম অঞ্জনা দেবী বলে মনে করা হয়। হনুমানজীর জন্মের পিছনে একটা বিশেষ পৌরাণিক কাহিনী রয়েছে। হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ অনুসারে তাহার জন্ম দেবতা এবং বানরীর মিলিত শক্তির ফলস্বরূপ। গ্ৰন্থ অনুয়ায়ী অঞ্জনা নামে এক অপ্সরা শাপগ্ৰস্থ হয়ে মর্ত্যে বানরীর রূপ নিয়ে এসেছিলেন। অপ্সরা অঞ্জনা তার শাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ভগবান শিবের তপস্যা করেন। ভগবান শিব অঞ্জনার তপস্যার প্রসন্ন হয়। পবনদেব ও তার তপস্যার সন্তুষ্ট হয়ে একটি বিশেষ প্রসাদ প্রদান করেন, সেই প্রসাদ অঞ্জনা গ্ৰহণ করেন এবং অঞ্জনার গর্ভে হনুমানের জন্ম হয়। সেই জন্য হনুমানকে পবনপুত্র বলা হয়। হনুমানের জন্মের সময় পবনদেব তাকে আশীর্বাদ করেছিলেন যার ফলে হনুমানজী বাতাসের মতো দ্রুতগামী ও শক্তিশালী হয়।
শৈশব কাহিনী -: হনুমানজী ছোটবেলায় ছিলেন খুব শক্তিশালী, সাহসী এবং অত্যন্ত দুষ্টু।কিশোর বয়সেই তিনি সূর্যকে ফল ভেবে আকাশে উড়ে গিয়ে সূর্যকে খেতে যায়। এই দেখে ইন্দ্রদেব তাকে বজ্রদ্বারা আঘাত করেন এবং তার কিছু ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। পবনদেব ছেলের উপর আক্রমণ দেখে পৃথিবীতে বাতাসের প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। তখন পবনদেবকে শান্ত করতে দেবতারা হনুমানকে বিভিন্ন আশীর্বাদ প্রদান করেন। দেবতাদের আশীর্বাদে তিনি অসীম শক্তি, সাহসী, বুদ্ধি ও অমরত্ব লাভ করেন। হনুমানজীর শৈশবে ঋষিদের উপর অত্যাচার করতেন এর ফলে ঋষিরা হনুমানজীকে অভিশাপ দিয়ে বলেছিলেন সে তার অসীম শক্তির কথা ভুলে যাবে তবে যখনই তার প্রয়োজন হবে তখনি তার স্মৃতি পুনরুদ্ধার হবে এবং তিনি তার সমস্ত শক্তি পুনরায় ফিরে পাবেন।
রামায়ণের কাহিনীতে হনুমানের গুরুত্ব -: রামায়ণ মহাকাব্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান চরিত্র হলো হনুমানজী। ভগবান রামচন্দ্রের প্রতি শুধু তাঁর অগাধ ভালোবাসা, ভক্তি ও আনুগত্য নয় বরং রামচন্দ্রের সামরিক অভিযানে তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ছিলেন। তাহার সাহসীকতার, বুদ্ধিমত্তা এবং আত্মত্যাগের জন্য তিনি রামচন্দ্রের সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ট সহযোগী এবং বিশ্বস্ত অনুগামী ছিলেন। রামায়ণের কাহিনী অনুযায়ী সীতা যখন রাবন কর্তৃক অপহরণ হয় সেই সময় রাম ও লক্ষন সীতার সন্ধানে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় সেই সময় হনুমানের সঙ্গে রাম ও লক্ষনের সাক্ষাৎ হয়। এরপর হনুমানজী রাম ও লক্ষনকে নিয়ে কিস্কিন্ধ্যার রাজা সুগ্ৰীবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করান এবং তাদের বন্ধুত্ব স্থাপন হয়।কিস্কিন্ধ্যার রাজা সুগ্ৰীব , হনুমানজী সহ তার বানর সেনাবাহিনীকে সীতার সন্ধান করার জন্য চারিদিকে পাঠান।
লঙ্কা যাত্রা -: হনুমানজীর সবচেয়ে বীরত্বপূর্ণ,ও বিখ্যাত কাজ হলো লঙ্কা যাত্রা, সীতার সন্ধান ও লঙ্কাকান্ড। হনুমানজী অনেক বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে সুমদ্র পার হয়ে লঙ্কায় পৌঁছান। তারপর রাবণের প্রাসাদে গোপনে প্রবেশ করেন। তারপর সীতার সাথে সাক্ষাত করেন, প্রমাণ সহ রামচন্দ্রের বার্তা সীতাকে দেয় এবং তাকে আশ্বাস দেন যে শীঘ্রই রামচন্দ্র তাকে উদ্ধার করবেন। এরপর হনুমানজী রাবণের সখের বাগান নষ্ট করেন, সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করে একাধিক বীর যোদ্ধাকে মারে ফলে, অবশেষে লঙ্কার প্রাসাদে আগুন লাগিয়ে পুনরায় রামচন্দ্রের কাছে এসে সীতার সন্ধান দেয়। এটি ছিল রাবণের পরাজয়ের বার্তা।
গন্ধমাদন পর্বত উত্তোলন -: যুদ্ধ স্থলে লক্ষন গুরুতর আহত হন তাকে সুস্থ করার জন্য সঞ্জীবনী বুটির প্রয়োজন হয়। সঞ্জীবনী বুটি না চেনার জন্য হনুমানজী গন্ধমাদন পর্বত পুরোটাই তুলে নিয়ে আসেন এই ঘটনা তার অসীম শক্তির পরিচয় দেয়।
হনুমান চালিশা -: হনুমান চালিশা হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রিয় ভক্তি মূলক স্তোত্র। হনুমানজীর প্রশংসিত রচিত ৪০ টি শ্লোক নিয়ে গঠিত। শ্লোকে হনুমানজীর জীবনের গুনাবলী এবং বীরত্বের কাহিনী গুলো প্রকাশিত। এটি পাঠ করা হয় তাহার প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্যের জন্য,ভক্তদের বিশ্বাস হনুমান চালিশা পাঠ করলে জীবনের সমস্ত বাধা,বিপদ ও সমস্যা চলে যায় সুখ ও শান্তি বজায় থাকে।
হনুমানজীর নির্ভীকতা ও আত্মবিশ্বাস -: হনুমানজীর সবচেয়ে বড় গুণ হলো তার নির্ভীকতা, আত্মবিশ্বাস এবং সাহস। তাহার আত্মবিশ্বাস ও সাহসিকতা এমনি, যে কোন বিপদকে ও তিনি অবহেলা করে এগিয়ে যান।এ থেকে আমাদের শিক্ষা দেয় যে আমাদের প্রতিকুল পরিস্থিতিতেও নির্ভীক ও আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে।
হনুমানজীর ভক্তি ও আনুগত্য -: হনুমানজীর ভক্তি ও আনুগত্য ভগবান রামচন্দ্রের প্রতি অতুলনীয়। এটি আমাদের শেখার যে ভক্তি ও আনুগত্য হলো সবচেয়ে বড় গুণ। রামচন্দ্রের প্রতি তার এই অগাধ ভালোবাসা ও ভক্তি তার অতিমানবীয় চরিত্র হিসেবে স্থান পেয়েছে ।
হনুমানজীর নিঃস্বার্থতা -: হনুমানজী কখনো নিজের স্বার্থের জন্য কিছু চাইনি ও ভাবেননি। তিনি সর্বদা অন্যদের কল্যানের, এবং রামচন্দ্রের সেবা ও সীতার মুক্তি এবং কন্যানের জন্য কাজ করেছেন। তাহার এই নিঃস্বার্থ ভাবনা, ও আনুগত্য কাজ আমাদের শিক্ষা দেয় যে জীবনের সবচেয়ে বড় গুণ হলো আত্মত্যাক ও সেবা।
হনুমানজীর শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা -: হনুমানজী শুধু মাত্র শক্তিশালী ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান, সবসময় কৌশল, জ্ঞান ও শক্তির মাধ্যমে কাজ করতেন। এ থেকে আমাদের শেখার যে শুধু শারীরিক শক্তি নয়,বুদ্ধি ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া ও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
আধুনিক সমাজে হনুমানজীর প্রভাব -: হনুমানজীর ভক্তি এবং সাহসিকতা আজকের দিনে আধুনিক সমাজে গভীর প্রভাব বিস্তার করে আছে। অনেক মানুষ তাকে তাদের ব্যক্তিগত জীবনে আদর্শ হিসেবে গ্ৰহণ করেন। তাঁহার ভক্তরা জীবনের সমস্যায় সুরক্ষা ও সমাধানের জন্য হনুমানজীকে দেবতা রূপে পূজা করেন এবং ভক্তরা শারীরিক ও মানসিক শান্তি অনুভব করেন। বিশেষ করে ক্রীড়াবিদ, যোদ্ধা এবং যারা মানসিক ও শারীরিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন তারা হনুমানজীর বীরত্ব ও সাহসিকতা থেকে অনুপ্রাণিত হন।
ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে হনুমানজীর পূজা প্রতিদিন হয়। তাঁহাকে বজরঙ্গবলী ও বলা হয়। তাহার জীবন কাহিনী এবং শিক্ষা শুধু ধর্মীয়ভাবে নয়, ব্যক্তিগত এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে ও গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার -: হনুমানজী হলেন হিন্দু ধর্মের অন্যতম দেবতা এবং অনুপ্রেরণার উৎস। তাহার অসীম শক্তি, বুদ্ধি এবং সাহসিকতার কাহিনী শুধু প্রাচীন কাহিনী নয়, বরং বর্তমান সমাজে ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।